
‘এই যে জুতোটা এখানে কেউ রাখে’- বাথরুম থেকে বেড়িয়েই নীতাকে এই কথা শুনতে হলো।’কেনো কোথায় রাখবো?’ নীতাও রেগে গিয়ে বললো।
সুজয় বরাবর এইরকমই।সবসময় নীতার দোষ খুঁজে বেরায়।আর ভাবে যা বলছে তা নীতার ভালোর জন্যই।ঘরে আসলেই সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যায় এটা এরকম কেন,ওটা ওখানে কেনো,কেন এটা করেছো,কেন ওটা করোনি- ধরনের নানা অভিযোগ,রোজ রোজ এই অভিযোগ শুনতে শুনতে নীতা ক্লান্ত বিধ্বস্ত হয়ে পড়ছে।দিন দিন সে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। সেদিকে সুজয়ের কোনো খেয়ালই নেয়।সে থাকে তার মেজাজ নিয়ে। এই নিয়ে নীতার মনে ভীষণ অশান্তি চলে। মাঝে মাঝে এত কষ্ট পায়, ঠাকুরকে বলে,’আমাকে তুলে নাও তোমার কাছে’।
সুজয় যেমন তার ব্যবসার কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে।নীতাও সারাদিন সংসারের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে।সুজয়ের কাজ যেমন মাথা খাটানোর। কিন্তু নীতার মাথা খাটানোর সঙ্গে সঙ্গে কায়িক পরিশ্রমও করতে হয়। সেটা কে বোঝে!
দুই ছেলেমেয়ের মা নীতা।মেয়ে তন্বিষ্ঠা ক্লাস টেনে পড়ে।ছেলে তন্ময়ের ক্লাস টু।তারপর ছেলে ভীষণ দুষ্টু। তাকে সামলাতেই নীতার সমস্ত শক্তি ফুরিয়ে যায়। সুজয় কি সেটা বোঝেনা?নীতা কিছুতেই বুঝতে পারে না। মাঝে মাঝে নীতা ভীষণ একা হয়ে পড়ে।মনে মনে বলে,’ভগবান আমি কাদের জন্য এত খাঁটি, সারাদিন এই রান্নাঘরে আর বাড়ির চৌহদ্দিতেই কাটিয়ে দিই।’কখনও কখনও ঠাকুরঘরেও বসে কান্না করে।
কিন্তু যখন নীতা বিয়ে হয়ে প্রথম শ্বশুরবাড়িতে এসেছিল। আর পাঁচটা মেয়ের মতোই অনেক স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল।মনে মনে স্বপ্ন সাজিয়েছিল। স্বামীকে নিয়ে সুখে শান্তিতে ঘর করবে। স্বামীকে নিয়ে মোটামুটি ২-৩ বছর শান্তিতেই ঘর করেছে।যদিও তার মধ্যে কখনও সখনও মনোমালিন্য -মিষ্টি মান-অভিমানের পালা চলেছে। তবে সেগুলোতো স্বামী -স্ত্রীর সম্পর্ককে আরো মজবুত করে তোলে। কিন্তু নীতার হ্মেত্রে হয়েছে উল্টো। যতদিন গিয়েছে সুজয় যেন খিটখিটে স্বভাবের হয়ে উঠেছে। ভালোবাসার ছোঁয়া যদি একদিন থাকে সপ্তাহের ছয়দিনই থাকে অশান্তির মেঘ নীতা আর সুজয়ের সংসারে।অথচ যখন নীতার বিয়ে ঠিক হয় নীতার মা নীতাকে বলেছিল, ‘শোন শ্বশুরবাড়িতে তুই শুধু স্বামীকেই ভালোবাসবি তা নয় কিন্তু সংসারের সবাইকে ভালোবাসবি দেখবি তারাও তোকে ভালোবাসবে।’নীতা তাই ভাবে -মা আমি কি বোকা মেয়ে তোমার। ভালোবেসেও সবার ভালোবাসা পেলামনা। সত্যিই আমি কি বোকা! হঠাৎ নীতার সম্বিৎ ফেরে কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দে।ছুটে যায় নীতা।দেখে তার দুষ্টু ছেলে তার শখের ফুলদানিটা মেঝেতে ফেলে দিয়েছে আর সেটা ভেঙে চৌচির হয়ে গিয়েছে। ঠিক যেমন নীতার মনটা ভেঙে চৌচির হয়ে গিয়েছে।
—ভেঙে ফেললি এত সুন্দর ফুলদানিটা? স্কুল থেকে এসেই শুরু করে দিয়েছিস!
—মা আমি ইচ্ছা করে ভাঙিনি।দেখতে গিয়ে পড়ে গেল।
—উফ্ আমি আর পারিনা। তুই যে কবে একটু শান্ত হবি।
নীতা তাড়াতাড়ি সব পরিস্কার করল।না হলে সুজয় যদি এসে যায়। আর দেখে এই অবস্থা। তাহলে নীতাকেই বলবে ছেলেটাকে একটু দেখে রাখতে পারোনা।সবেতে জ্বালা নীতার।
ভাবতে ভাবতেই সুজয় ঘরে চলে আসলো। যদিও তার আগেই নীতা তাড়াতাড়ি সব পরিস্কার করে ফেলেছিল।
—‘গিজারটা চালিয়ে দাও।স্নান করবো।’বলেই সুজয় বারান্দায় গেল তেল মাখতে।
—ঠিক আছে।
নীতা তাড়াতাড়ি গিজার চালিয়ে সুজয়ের খাবার রেডি করতে লাগলো। সুজয়ের আবার সব পরিপাটি না হলে ভীষণ রেগে যায়। যেমন তিনি কাঁচের গ্লাস ছাড়া জল খাবেন না। থালায় যদি এক ফোঁটা জল থাকে তাতেও রেগে যাবে।তাই এই নিয়ে নীতা ভীষণ ভয়ে ভয়ে থাকে। সব কিছু ফেলে আগে সুজয়ের খাওয়ার সব রেডি করে নেয়।
সুজয় স্নান থেকে বেরোলে নীতা টেবিলে খাবার দিয়ে সুজয়ের পাশে বসে। নীতার সঙ্গে সুজয়ের কোনোদিনই একটানা দু’ মিনিট কথা এগোয়না।কারন সুজয় যখন কিছু বলবে তার মাঝখানে কোনো কথা বলা যাবেনা। যদি কিছু প্রশ্ন নীতার থেকেও থাকে তাও বলা যাবেনা। বললেই সুজয় মুখ খারাপ করবে আর তাতেই নীতারও মন খারাপ হয়ে যায়।আর কথা এগোয় না।
— আজ আমি একটু বাজারে যাবো কিছু টাকা দিওনা।
—কেন কি কিনবে?
—ওই যে ছেলে মেয়ের জন্য কিছু পোশাক। ওরা বড় হচ্ছে। শীতের পোশাকগুলো ছোটো হয়ে গিয়েছে।
—ওঃ কত দেব?
—কি করে বলবো কত খরচ হবে।তুমি দাও কিছু,যা লাগবে আন্দাজ করে। আমি অতো গুণে বলতে পারবোনা।
—ঠিক আছে।
বলে যা দিল তাতে নীতা ভাবলো এই টাকায় হয়তো হবেনা।কিন্তু তা মুখ ফুটে বলার সাহস হলোনা।ভাবল,’আমার কাছে কিছু আছে,তাই দিয়েই মিশিয়ে বাজার করে নেব’।দুপুরের খাওয়া সেরে নীতা এখন একটু বিশ্রাম নেওয়ারও সময় পায়না।নীতার বরাবরের অভ্যাস দুপুরে খাওয়ার পর নিয়মিত খবরের কাগজ পড়ার। আর রাতে বিছানায় শুয়ে গল্পের বই পড়া।এখন রাতে গল্পের বই পড়ার বদলে মাঝে মাঝে গান শুনতে ইচ্ছা করে।কিন্তু কোনোটাই এখন নিয়মিত হয়ে ওঠেনা।
বিকেলে ছেলে মেয়েকে নিয়ে বাজারে গিয়ে খুব আনন্দ করে ওদের সব পোশাক কিনলো।মোমো,ফুচকা,পপকর্ন খাওয়ালো।ওরা খুব খুশি। মেয়েতো নীতার বন্ধু হয়ে উঠছে দিন দিন। ছেলেটাও ভীষণ মা ন্যাওটা।মেয়েতো বলেই ফেললো—‘মা ভাগ্যিস বাবা আসেনি’।
নীতা চোখ বড়ো বড়ো করে বলল—কেন?
—ধূর বাবা আসলে এত মজাই হতোনা। বলতো তাড়াতাড়ি কর।আর না ফুচকা খেতে হবেনা,এটা কিনতে হবেনা,ওটা করতে হবে না।
—এই এসব বলতে হয়না। বাবা তো ভালোর জন্যই বলে।এগুলো খাওয়া কি ভালো?
—আচ্ছা মা আমরা কি রোজ খাই। বাবাও কি ছোটো বেলায় এটা ওটা খেতোনা?বাবা যে কেন বোঝেনা?!
অসহায় নীতা কি বোঝাবে আর কি বলবে মেয়েকে ভেবে পায়না।
খুব আনন্দ করে বাজার সেরে বাড়ি ফিরে সুজয়কে নীতা সব জামা দেখতে বললো।জামা কয়েকটা দেখেই বলল—কত গেল?
এই কথায় নীতা বরাবরের মতো আঘাত পেলো।
—কত গেল তোমার জেনে কি লাভ?দেখো জামা গুলো কেমন হয়েছে?
—হুম ভালোই।
বলে সুজয় চলে গেল।নীতা বলার সাহস পেলনা সুজয়ের দেওয়া টাকায় সব বাজার হয়নি। নীতার জমানো টাকার থেকেও খরচ করতে হয়েছে। সুজয় জানলে বলবে,তোমার খরচের হাত বড্ড বেশি।কিন্তু নীতা জানে সে খরচ কেনো করে। ছেলে মেয়েকে একটু আনন্দ দিতে। এখনকার ছেলেমেয়েরা যেমন বছরে বছরে বাবা মার সাথে ঘুরতে যায়।সপ্তাহ শেষে বাবা মার সাথে রেষ্টুরেন্টে খেতে যায়।বাড়ি বা পাড়ার মাঠে ছেলে মেয়েরা একসাথে খেলে।কোনোটাই তার সন্তানরা পায়না।ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের পড়ার চাপ আর এই না পাওয়াতে ছেলে মেয়েরা বড় হোক এটা নীতা কিছুতেই চায়না। উপরন্তু ওরা ছোটো থেকে দেখে আসছে ওদের বাবা ওদেরকে ছোটো বলে বাড়িতে রেখে মাকে নিয়ে ব্যবসায়িক কাজে দেশ -বিদেশ যাচ্ছে। এই সব নিয়ে নীতা খুব ভাবে, কষ্ট পায়।সুজয় ভাবে সন্তানদের যেভাবে বোঝাতে শেখাবে সেভাবেই বুঝতে শিখবে। কিন্তু নীতার ধারনা অন্য।ওরা বুঝলেও ওদের কষ্টটা কিন্তু কমবে না। তাই নীতা যেটুকু সুযোগ পায় তার মধ্যে দিয়েই চেষ্টা করে ওদের আনন্দ দিতে।
নীতা জানেনা কতদিন এইভাবে চলবে।সারাদিন কাজকর্মে একপ্রকার দিন কেটে যায়। রাতের বেলায় নীতা চোখ বুজলেও ঘুম আর তার আসেনা। মনে যত রাজ্যের কষ্টরা ভিড় করে।
এইভাবে চলতে চলতে মেয়ের বিয়ের বয়স হয়ে যায়। নীতার সব অপূর্ণ স্বপ্নের মধ্যে একটা স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। তার মেয়ে আজ গানের জগতে নাম করেছে। আজ সবাই নীতাকে চেনে গায়িকা তন্বিষ্ঠার মা হিসাবে। এটা নীতাকে ভীষণভাবে গর্বিত করে। নীতা সব দুঃখ ভুলে যায় যখন দেখে মেয়ের গান লোকের মুখে মুখে ঘোরে।
আজ নীতার আনন্দ-দুঃখের দিন একই সাথে। আজ তন্বিষ্ঠার বিয়ে।সে আজ তার নাড়ির টান, নাড়ির বন্ধন ছিন্ন করে নিজের সংসারে চলে যাবে। নীতা মনে মনে বলে ওঠে -হ্যাঁরে মা আজ থেকে তোর মা যে বড্ড একা হয়ে পড়বে।কার কাছে সব কথা বলবে। নীতা ভাবে এটাই জীবন। সেও একদিন তার মাকে ছেড়ে এসেছে তার নিজের সংসারে,নতুন একটা পরিবেশে।
—মা, মা,ওমা কি ভাবছো?
তন্বিষ্ঠার ডাকে নীতা তাড়াতাড়ি চোখের জল মুছে মেয়ের দিকে তাকায়।
—বল,কি হয়েছে?ডাকছিস কেন?
—মা তোমাকে বাবা ডাকছে।
—ও,আচ্ছা যাচ্ছি।
সুজয়ও খুব ব্যস্ত আজ।সুজয় আর নীতার সম্পর্কের মধ্যে ভাঁটা পড়লেও সুজয় বাবা হিসেবে ছেলে মেয়ের জন্য যা করার করেছে। হয়তো ওদের সব আশা পূরণ করতে পারেনি। কিন্তু তন্ময় তন্বিষ্ঠাকে কম ভালোবাসেনা।
নীতা গিয়ে দেখে সুজয় বাড়ি ভর্তি লোকজনকে এড়িয়ে নিজের ঘরে সোফায় গা এলিয়ে বসে আছে। নীতাকে দেখে কাছে ডাকলো।
—বসো নীতা।
—বলো ডাকছিলে কেনো?
—বসোনা,আজকালতো আমার কাছেই একটু বসোনা।
—দেখো আজতো বাড়িভর্তি লোকজন।আর কত কাজ কি করে এখন বসি বলোতো। কি বলতে চাও তাড়াতাড়ি বলো।
—নীতা আজ আমার মনটা ভীষণ খারাপ লাগছে।
—মেয়ের জন্য?
—হ্যাঁ,দেখতে দেখতে আমাদের সেই ছোট্ট মেয়েটা আজ কত বড় হয়ে গেল।আর আজ সে আমাদের ছেড়ে চলে যাবে, পর হয়ে যাবে।
—হুম।
—ভাবছি এই এত বড় বাড়িতে কি করে থাকবো।বড্ড ফাঁকা হয়ে যাবে।
—কেন তন্ময় আছেতো।ওর বউ আসবে।সংসার আবার ভরে যাবে।মেয়ে মাঝে মাঝে আসবে।
—কিন্তু আমার মেয়েটাকে তো সবসময় কাছে পাবোনা।
—তুমি এত ভাবছো কেন বলতো। জীবন যেদিকে যেভাবে নিয়ে যাবে সেদিকে সেভাবেই যেতে হবে।
—নাগো আজ বুঝতে পারছি সন্তানদের ছেড়ে থাকার কষ্টটা কি!
নীতা মনে মনে ভাবলো,এই তুমিই একদিন আমার কষ্ট,আমার বাবা মার কষ্টের কথা ভাবনি। বিয়ের পর যখন মন খারাপ করতাম তখন কদিন ভালোবেসেছো,বুঝিয়েছো।কিন্তু সময় যত গড়িয়েছে ততই তুমি পাল্টে গিয়েছো।মা-এর সাথে যদি একটু ফোনে ৫ মিনিটের জায়গায় ১০মিনিট কথা বলেছি তাই নিয়েই অশান্তি। কেন আমি এত ফোনে কথা বলি।
—নীতা শুনছো…
নীতার সম্বিৎ ফেরে।
— জানোতো আজ….
—থাক আর এখন কোনো কথা শুনবোনা।চলো বাইরে চলো।আত্মীয়স্বজন সব চলে এসেছে।
—নীতা একটা কথা বলার ছিল তোমাকে।
—বলো কি বলবে।
—সরি।
—(নীতা অবাক চোখে তাকিয়ে) কেন?!
—সরি নীতা,তুমিও তোমার মা বাবাকে ছেড়ে এসেছো।এখন বুঝতে পারছি সেদিন তারা কত কষ্টে তোমাকে আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন।
—থাকনা এসব কথা,চলো…
—না,নীতা আমাকে বলতে দাও আজ।তোমাকে তোমার মা বাবার সাথে ঠিকমতো কথা পর্যন্ত বলতে দিতামনা।আজ যদি আমার মেয়েকেও…..
বলে সুজয় ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।
নীতা সুজয়কে সামলে নিল। নিজেকেও সামলে নিল।
—কিসব ভাবছো।আজ সব শুভ শুভ ভাবো।এমন কিছু হবে না।আমাদের মেয়ে খুব সুখি হবে দেখো।তাই যেন হয় নীতা তাই যেন হয়।
নীতা জানলা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলো রোদ ঝলমলে নীল আকাশের মধ্যে দিয়ে সাদা তুলোর মতো মেঘগুলো ভেসে যাচ্ছে।আর নীতা শুনতে পেলো, যেতে যেতে বলে যাচ্ছে নীতা তুমি ভালো থাকো,সুখে থাকো।
**************************************
ছবি সৌজন্যে…… Pinterest.com