
রোজ সকাল ৮টায় বাড়ি থেকে বেড়িয়ে বিকেল ৫টায় বাড়ি ফেরা, এই গতানুগতিক জীবনে দিন দিন হাফিয়ে উঠছে বন্যা। অফিসের কাজের চাপে মাঝে মাঝে দম বন্ধ হয়ে আসে। মনে হয় সব ছেড়ে ছুট্টে কোথাও হারিয়ে যায়। কিন্তু উপায় নেই। কাজকে ফাঁকি দিয়ে হারিয়ে যেতে পারলেও মাকে ফাঁকি দিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। মা-এরতো বন্যা ছাড়া আর কেউ নেই। বাবা – মা’র একমাত্র সন্তান বন্যা। ছোট থেকে খুব আদর যত্নে মানুষ হলেও বিলাসিতা ছিল না জীবন যাপনে। ফাইনাল ইয়ার চলছিল কলেজে। দু চোখ ভরে অনেক স্বপ্ন। বিষয় ছিল বাংলা সাহিত্য। স্বপ্ন ছিল এম . এ করার পর বাংলা সাহিত্যে নাটক নিয়ে পি . এইচ . ডি করার। সেইমতো পড়াশোনা করছিল। প্রস্তুতি নিচ্ছিল।কিন্তু বিধি বাম। সবেমাত্র ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা শেষ হয়েছে। সেই সময়ই বন্যার বাবা আচমকা সেরিব্রাল অ্যাটাকে বন্যাদের ছেড়ে চিরকালের জন্য চলে যান। সাজানো গোছানো সুন্দর জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেল। সংসারের সব দায়িত্ব বন্যার ওপর এসে পড়ল। বাবা মারা যাবার পর যেন মাও কেমন হয়ে গেল। তারও সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেল। মন খারাপের চাদরে যেন সবসময় মুড়ে রাখত নিজেকে। বন্যা সবসময় চেষ্টা করতে লাগল মাকে খুশি রাখতে, সুস্থ রাখতে। বন্যার বাবার হোসিয়ারীর ব্যবসা ছিল। সেটা বন্ধ হয়ে গেল। বন্যা সংসারের হাল ধরতে একটা প্রাইভেট কোম্পানীতে কাজে যোগ দিল।
___ কাল রবিবার। চলো মা একটু ঘুরে আসি।
___কোথায় যাবি?
___চলো একটু শপিং করে বাইরে খেয়ে আসি।
___না থাক।
___না না চলো। ফাইনাল কিন্তু। আমরা কাল বেরোবো।
এইভাবেই বন্যা মাকে সবসময় খুশি রাখার চেষ্টা করে যায়। এখনতো মায়ের ভালো মন্দ সব দায়িত্ব তারই ওপর।
আজ অফিস থেকে বন্যা তাড়াতাড়ি বেরিয়েছে। সন্দীপ বলেছে আজ দেখা করবে। অনেকদিন ওরা একসাথে সময় কাটায়নি।তাই একটু তাড়াহুড়ো করেই কাজ সেরে বন্যা অফিস থেকে বেরিয়েছে। চকবেড়িয়া বাস স্ট্যান্ডের যে ছাউনি আছে সেখানেই সন্দীপ বসে আছে। প্রায় দৌড়তে দৌড়তে বন্যা সেখানে গিয়ে দাঁড়ায়।
___একটু দেরী হয়ে গেল। সরি।
___কি আর করা যাবে। চলো।
দুজনে হাঁটতে লাগল পাশাপাশি। হাঁটতে হাঁটতে দুজনের মধ্যে অনেক কথা হলো। আসলে ওদের একটু নির্জন নিরালায় বসে ঘন্টার পর ঘণ্টা সময় কাটানোর মতো সময় কারোরই নেই। সন্দীপও বাবা-মা’র একমাত্র সন্তান। সন্দীপের ওপরও অনেক দায়িত্ব। তবে কেউই ওদের সম্পর্কের কথা বাড়িতে বলে উঠতে পারেনি।
এইভাবেই বেশ কয়েক বছর কেটে গেল। বন্যার মা এবার বন্যার বিয়ের জন্য তোড়জোড় শুরু করেছেন। মেয়ের বিয়ের বয়স হয়েছে। এবার মেয়ের একটা বিয়ে দিতে পারলে বন্যার মা নিশ্চিন্ত হতে পারে। কিন্তু বন্যার চিন্তা মাকে একা ছেড়ে কি করে সে থাকবে।
___কিরে এবার বিয়ে সংসার করতে হবে। আর কতদিন এইভাবে থাকবি।
___তোমাকে একা ছেড়ে আমি থাকবো কি করে মা!!
এদিকে সন্দীপের বাড়িতেও তার বাবা -মা বিয়ের কথা বলা শুরু করেছে। সন্দীপ তার মাকে বন্যার কথা বলে। সন্দীপের মা বলে___ঠিক আছে একদিন বন্যাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আয়।
___ঠিক আছে মা।
বন্যাও তার মাকে সন্দীপের কথা বলে। বন্যার মা বলে___তোরা যদি একে অপরকে পছন্দ করিস, ভালোবাসিস তাহলে একসাথে তোরা সংসার করবি এই ব্যাপারে আমার কোন আপত্তি নেই।
অবশেষে দুই বাড়ির কথাবার্তার মাধ্যমে বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হলো আর বেশ ধুমধাম করেই বন্যা ও সন্দীপের বিয়ে হয়ে গেল।
বন্যা মাকে ছেড়ে তার নতুন সংসারে আসল। শ্বশুর, শাশুড়ি, স্বামীকে নিয়ে বেশ গুছিয়ে সংসার করতে লাগলো। আর মাঝে মাঝে মাকে দেখে আসা, ডাক্তার দেখানোর কাজটাও করতো। এইভাবে পাঁচ বছর কেটে গেলো। সবই ঠিকঠাক চলছিল, সমস্যা হলো অন্য জায়গায়। বিয়ের পর পাঁচ বছর কেটে গেলেও বন্যা মা হতে পারছেনা। ক্রমে ক্রমে শ্বশুর, শাশুড়ির মন থেকে বন্যা দূরে সরে যেতে লাগলো। উঠতে বসতে শুনতে হতো__’আর বোধ হয় বংশধরকে দেখে যাওয়া হবেনা’। বা ‘আমাদের বংশধর কি আসবেনা’।
এরপর যত দিন যেতে লাগলো, ধারালো ছুরির মতো কথা বন্যার মনকে এফোড় ওফোড় করে দিতে লাগলো। প্রতি রাতেই চোখের জল ফেলে মাথার বালিশ ভেজাতো।সন্দীপ কখনো কখনো তাকে বোঝাতো। কখনও বা চুপ করে পাশ ফিরে শুয়ে থাকতো। ডাক্তারি রিপোর্টে বলেছে বন্যা কোনোদিন মা হতে পারবে না। কিন্তু সন্দীপ বা বন্যা সেকথা বাড়ির কাউকেই বলতে পারছেনা। বন্যা প্রতিনিয়ত পাওয়া কষ্টের মধ্যে সেদিনের আরো বেশী কষ্ট পেল যেদিন সন্দীপের মা বললেন___শোন খোকা তুই আমাদের একমাত্র সন্তান। আমাদের সব আশা আকাঙ্ক্ষা তোকে ঘিরেই। তোরা যদি একজন বংশধর দিতে না পারিস তাহলে কি করে হয়।
___কেন মা এত তাড়া কিসের?
___তাড়া! পাঁচ বছর হয়ে গেল। আমাদের কখন কি হয়ে যায়। আর কত অপেক্ষা করবো।
___মা, তুমি এসব নিয়ে চিন্তা করোনা।
___না বাবা তুই বরং বন্যাকে ডিভোর্স দে। তোর আর একটা বিয়ে দেব।
বন্যার সেদিন পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছিল। কোনমতে নিজেকে সামলে ঘরের দরজা বন্ধ করে চোখের জলে কষ্টকে মোছার চেষ্টা করেছে।
___না মা এটা কি করে সম্ভব। আমি কিছুতেই বন্যাকে ছাড়তে পারবো না।
___ওঃ! তুই মাকে কষ্ট দিতে পারবি। মায়ের একটামাত্র আশা সেটাও পূরন করতে পারবিনা।
___কি বলছো মা! তোমাকে আমি কষ্ট দিচ্ছি।
___হ্যাঁ দিচ্ছিসতো।
___না মা, তোমাকে যেমন আমি ভালোবাসি। তোমার প্রতি যেমন আমার দায়ভার আছে। বন্যা আমার স্ত্রী। ওর প্রতিও আমার দায়ভার আছে। ওকেও আমি ভালোবাসি।
___আচ্ছা তাহলে তুই ভুলে যা তোর মা আছে।
এইসব কথার মাঝে বন্যা হাতে একটি সুটকেস নিয়ে মা-ছেলের সামনে এসে দাঁড়ায়।
___মা আপনার কোন চিন্তা করতে হবেনা। আমি এই সংসার, সন্দীপকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি। আর ফিরবো না। সময়মতো আমাদের ডিভোর্স হয়ে যাবে। তারপর আপনার ছেলের আবার বিয়ে দিতে পারবেন।
___কি বলছো বন্যা, তুমি চলে যাচ্ছো মানে। আমি কি তোমাকে চলে যেতে বলেছি।
___না, সন্দীপ এতদিন তোমাদের কথামতো চলেছি। আজ না হয় একটা সিদ্ধান্ত আমি নিই।
___দাঁড়াও তুমি, আমি রেডি হয়ে আসি। তুমি যেখানে যাবে আমি পৌঁছে দিয়ে আসবো।
___তার দরকার হবেনা সন্দীপ, আমি চলে যেতে পারবো।
___না, তুমি দাঁড়াও।
কিছুক্ষণ পর সন্দীপ একটা সুটকেস হাতে আসল। বলল___মা, আমি বন্যাকে নিয়ে চলে যাচ্ছি। ওর হাত যখন ধরেছি তখন জীবনে চলার পথে ওকে একা ছেড়ে দিতে পারবোনা। ওকে যদি একা ছেড়ে দিই তাহলে নিজেকে কখনও ক্ষমা করতে পারবো না। আর তোমার কি ভালো লাগবে বলো, তুমিও তো একটা মেয়ে। মেয়ে হয়ে মেয়েদের কষ্ট বুঝলে না! না মা, আমি পারবো না। আমায় ক্ষমা করো।
বন্যা সন্দীপের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। হাতে হাত রেখে দুজনে বেরিয়ে আসল।
************************************
উদাসী মন