
শুভময় বাজার থেকে দশদিনের সব বাজার করে ঘরে ঢুকলো। সকাল ৯.৩০ বাজে। সব্জি, মুদিখানা আর শ্রীময়ীর দরকারি টুকিটাকি কিছু কিনে এনেছে। এখন যা পরিস্থিতি ঘন ঘন বাজারে যাওয়া রীতিমতো ভয়ের ব্যাপার। আর বাঙালি তো মরে গেলেও খাওয়া ছাড়ে না। বাজারের ভীড়ই সেই কথা প্রমাণ করে।
শুভময় বাজার গুলো রেখে বাথরুমে ঢুকলো। শ্রীময়ী আগেই বাথরুমে তোয়ালে রেখে দিয়েছিল। সাবান দিয়ে ভালো করে স্নান করে শুভময় ড্রয়িং রুমের সোফায় গা এলিয়ে দিল। শ্রীময়ী ফ্যান চালিয়ে দিল। যা গরম পড়েছে। ভ্যাপসা গরমে নাজেহাল অবস্থা। কদিন ধরে বৃষ্টির দেখা নেই। শুভময় বলল__ শ্রী আর এক কাপ চা হবে? খবরের কাগজ পড়তে পড়তে শুভময়ের চা খাওয়ার নেশা। রান্নাঘর থেকে শ্রীময়ী বলল__ হ্যাঁ দিচ্ছি। রুটি হয়ে গেছে একবারে ব্রেকফাস্টও করে নাও। আমি আবার সব্জি গুলো সব ধুয়ে রোদে রাখব।
__ হ্যাঁ তাহলে তাই দাও। আমি ব্রেকফাস্টটা করে নিই।
শ্রীময়ী শুভময়ের চা আগে করে দিয়ে রুটি তরকারির প্লেট ডাইনিং টেবিলে ঢাকা দিয়ে রেখে গেল। এখন এই এক জ্বালা হয়েছে। যেদিন সব বাজার আনবে ধোওয়ার মত সব জিনিস ধুয়ে রোদে রেখে আবার সব গুছিয়ে রাখতে হয়। একেতে এখন কাজের লোক আসছেনা। সব একা একা করতে হচ্ছে। তার ওপর আবার উপরি কিছু কাজ বেড়েছে। শ্রীময়ী আর পেরে ওঠে না। সেই সকাল ৬ টায় ঘুম থেকে ওঠা তারপর শুরু যুদ্ধ। যুদ্ধই বটে। ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে দৌড়ে দৌড়ে কাজ করতে হয়।
__ শ্রী আজ রুটির তরকারিটা খুব ভালো হয়েছে।
শুভময় বোঝে শ্রীময়ী এতে খুব খুশি হয়। এই গরমে সব কাজ একা হাতে করে আবার সবার জন্য রান্না করে। এর বদলে ও কিছুই চায়না। একটু প্রশংসা, একটু ভাল কথাতেই ও খুব খুশি হয়।
শ্রীময়ী বলল__ আর একটু নেবে?
__ না না, আমার খাওয়া হয়ে গিয়েছে। একটু রেখে দিও, রাতের রুটি এই তরকারি দিয়েই খাব।
__ হ্যাঁ রেখে দেব।
শুভময়ের অফিস এখন বন্ধ। বাড়িতে সময় কাটতেই চায়না। টিভি, মোবাইল, কম্পিউটার আর গল্পের বই এই হল সময় কাটানোর সঙ্গী। মাঝে মাঝে সন্ধ্যের দিকে পরিবারের সবার সাথে একটু গল্প। আর ফোনে আত্মীয় কয়েকজনের খবরাখবর নেওয়া।
শুভময় টিভি চালিয়ে বসল।
__ দেখ শ্রী আজ আমাদের রাজ্যেই ১হাজার ছাড়িয়ে গেল আক্রান্তের সংখ্যা।
শ্রীময়ী রান্না ঘর থেকেই উত্তর দিল__ হুম, দেখ আরো বাড়বে। কি যে হবে। আর ভালো লাগছে না।
শুভময় আর শ্রীময়ীরএকমাত্র সন্তান অভীক। ওরও আর কিছু ভালো লাগছে না। স্কুল নেই, পড়তে যাওয়া নেই, বাইরে বেরোতেই পারছেনা। অভীক এসে বাবার পাশে বসলো।
__ কিরে বাবু ঘুম ভাঙলো? এত বেলা অবধি ঘুমায় কেউ?
__ কি করবো? অত সকালে উঠেই বা কি করবো?
সত্যিই তো এই একঘেয়ে জীবন ওদেরই বা আর কতদিন ভাল লাগে।
__ বাবা কবে সব ঠিক হবে? আর ভালো লাগছে না।
__ কিছু বলা যাচ্ছেনা। ভ্যাকসিন না আসা পর্যন্ত কিছুই বলা যাচ্ছেনা।
__ ওহো ভগবান কিসব যে হয়ে গেল।
__ হ্যাঁরে বাবু আজ তোর অনলাইন ক্লাস নেই?
__ হ্যাঁ আছে তো, বিকালে।
__ ওঃ, যা খেয়ে আয়।
অভীক খেতে চলে গেল।
কয়েকদিন পরের ঘটনা। শুভময়ের শরীরটা খারাপ লাগতে শুরু করল। জ্বর জ্বর ভাব, শুকনো কাশি ও আছে। বাড়ির সবাই খুব চিন্তিত হয়ে পড়ল। বাড়িতেই প্যারাসিটামল, অ্যাজিথ্রাল কিনে খেতে লাগল। জ্বর কমে আবার আসে।
__ তোমার কি গলা ব্যাথাও আছে?
__ না শ্রী, গলা ব্যাথা নেই কিন্তু এই কাশি খুব কষ্ট দিচ্ছে।
শ্রীময়ী দিনে তিনবার গরম জল, গরম জলের ভ্যাপার সব কিছুর ব্যাবস্থা করে দেয়। এক সপ্তাহ হয়ে গেল শুভময়ের শরীর ঠিক হলোনা। জ্বর ১০০°এর ওপরে উঠছে না ঠিকই কিন্তু পুরো কমছেওনা।
__ বাবা, তুমি এবার টেস্টটা করিয়ে নাও।
__ হুম, তাই ভাবছি।
বাড়ির সবার ভীষণ চিন্তা, সাথে তো ভয় আছেই। কি হবে! টেস্ট করালে রিপোর্ট কি আসবে! পজিটিভ না নেগেটিভ! ভীষণ উৎকণ্ঠায় দিন কাটতে লাগল।
শুভময় হাসপাতালে গিয়ে সোয়াব টেস্ট করিয়ে আসল। ওখান থেকে বলল, ৫দিন পর রিপোর্ট বেরোবে। ততদিন হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে।
বাড়ির বাইরে কেউ বের হচ্ছেনা। প্রবল উৎকণ্ঠায় দিন কাটছে। প্রত্যেকের চোখে মুখে টেনশন চেপে বসেছে। শুভময় ভাবতে লাগল যদি রিপোর্ট পজিটিভ আসে তাহলে কি করতে বলবে কে জানে। হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে নাকি বাড়িতেই থাকতে বলবে। হাসপাতালে গেলে সব কে করবে! শ্রীময়ী একা সব সামাল দিতে পারবে তো! আর সব থেকে ভয়ের ব্যাপার শুভময়ের যদি রিপোর্ট পজিটিভ আসে তাহলেতো শ্রীময়ী, অভীকেরও…………… না না আর ভাবা যাচ্ছেনা। কি হবে ঠাকুর! রক্ষা করো_এইসব সাত পাঁচ ভেবে শুভময়ের মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এদিকে ৫টা দিন যেন কিছুতেই কাটছে না।
__ শুভ কি ভাবছ?
শ্রীময়ীর ধাক্কায় শুভময়ের সম্বিৎ ফেরে।
__ না, কি আর ভাবব। জানোইতো এখন কি ভাবনা থাকতে পারে।
__ অত ভেবোনা। কিচ্ছু হবেনা। দেখো এটা তোমার ভাইরাল ফিভার ছাড়া আর কিচ্ছু না। যদিও শ্রীময়ী বলল একথা কিন্তু টেনশন শ্রীময়ীরও হচ্ছে। তবু শ্রীময়ী কিছু বুঝতে দিচ্ছে না। শুভময়কে সাহস যোগাতে হবে যে। এই সময় মনের সাহস রাখাটা খুব জরুরি। নাহলে শরীরের ইমিউনিটি পাওয়ার কমে যেতে পারে।
একদিন দুদিন করে অবশেষে পাঁচ দিন কাটল। আজ শুভময়ের সোয়াব টেস্টের রিপোর্ট আসার কথা। সকাল ৮টায় ফোন বেজে উঠল। কারোর পা সরছেনা। অগত্যা শ্রীময়ী গিয়ে ফোনটা ধরল। প্রবল উৎকণ্ঠায় শ্রীময়ীর দিকে অভীক আর শুভময় তাকিয়ে আছে। শ্রীময়ী ওদের দিকে তাকিয়ে।
__ মা।
অভীক আর শুভময় দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
__হ্যাঁ মা শুভর জ্বরটা এখন নেই। কিন্তু কাশি সারছেনা।আজ রিপোর্ট আসবে। তোমাকে জানাবো। এখন রাখি।
__ আচ্ছা টেনশন করিসনা।ভগবানকে ডাক।
সময় যেন কাটতে চায় না। সকাল ৮.৩০। আবার ফোন। এবারও সবাই টেনশনে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ ফোন ধরছেনা। অগত্যা শ্রীময়ীই ফোনটা ধরলো।
__ হ্যাঁ, এটা শুভময় অধিকারীর নাম্বার।
এদিকে প্রবল উৎকণ্ঠায় বাবা ছেলে শ্রীময়ীর দিকে তাকিয়ে আছে।
__ হ্যাঁ বলুন।
ফোনের অপর প্রান্তে কিছু বলল। শুনে শ্রীময়ী ও, আচ্ছা, ঠিক আছে বলে ফোন রেখে দিল।
বাবা ছেলে উৎকণ্ঠা ভরা জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে শ্রীময়ীর দিকে তাকিয়ে আছে।
শ্রীময়ী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে চিৎকার করে বলে উঠল__নেগেটিভ।
আনন্দে উত্তেজনায় বাবা ছেলে একে অপরকে জড়িয়ে ধরলো। সারা জীবনে পজিটিভকে গুরুত্ব দিয়ে এসেছে। আজ জীবনে প্রথমবার নেগেটিভকে এত গুরুত্ব দিল।
*********************************** উদাসী মন