
আজ কলেজে পূনর্মিলন উৎসব। আজকের দিনটা আমাদের সবার কাছে একটি আনন্দের দিন। কত বন্ধু বান্ধবীর সাথে দেখা হবে। কত কথা, কত স্মৃতি। কলেজ জীবনের পর কে কোথায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে গিয়েছে। কারোর কারোর সাথে যোগাযোগ এখনও আছে কিন্তু সবার সাথে নেই। মনের কোনে কখনো কোন নাম উঁকি দিয়ে যায়। সে কোথায় থাকে, কেমন আছে জানিনা।
__ কিরে মানালি কেমন আছিস?
_ আরে বন্দনা তুই, আমি ভাল আছি, তুই কেমন আছিস?
__ আমি ভাল আছি। বল তোর কি খবর?এখন কোথায় থাকিস? পরিবারের খবর কি?
আরে দাঁড়া দাঁড়া সব একে একে বলবো। চল আমাদের সেই কমন রুমে গিয়ে বসি। কতদিন বসিনা।
__ হ্যাঁ চল কতদিন পর বসবো ওই ঘরটায়।
দুই বান্ধবী চলে গেল কমন রুমের দিকে। একটা টেবিলের সামনে পাশাপাশি বসে দুই বান্ধবী। অনেক গল্পকথা।
__ হ্যাঁরে বন্দনা সুমনা কেমন আছেরে?
__ সুমনার খবর তুই কিছু জানিসনা?
__ নাতো। কলেজের ফাইনাল ইয়ারের পর আরতো তেমন যোগাযোগ নেই সবার সাথে।
__হুম, কে কোথায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল।
__ স্বপ্না, প্রীতি, মৌসুমীর সাথে যোগাযোগ আছে। স্বপ্না একটা সরকারি স্কুলে শিক্ষিকা হয়েছে।
__ আর প্রীতি? ওর কি খবর?
__ প্রীতি বিয়ে করে অস্ট্রেলিয়া আছে বরের সাথে। মাঝে মধ্যে ফোন করে, কথা হয়। ভালোই আছে।
__ আর মৌসুমী? ওকি যাকে ভালবাসাতো তার সাথেই বিয়ে হয়েছে?
__ হ্যাঁরে অঙ্কুশকেই বিয়ে করেছে। ওদের একটা মিষ্টি মেয়ে হয়েছে। ওরা উত্তর কলকাতায় থাকে। ভালোই আছে।
__ বাঃ কতদিন পর ওদের সবার কথা জানলাম।
__ কিরে বন্দনা সুমনার কথা বললিনাতো?
__ হুম, আসলে সুমনার জীবনটা ঠিক সুখের হয়নিরে।
__ কেন কি হয়েছে?
__ আসলে জানিস তো বেশি অহংকার ভাল নয়।
__ হ্যাঁ তো কি হয়েছে বলনা।
__ ওর বিয়েটা টেকেনি। শুনেছি ও নাকি আলাদা থাকে।
__ ওঃ। কেন ওর শ্বশুর বাড়ির লোক না স্বামী_কোন দিক দিয়ে সমস্যা ছিল?
__ আসলে অত কিছু জানিনারে।সেদিন শপিং মলে গিয়েছিলাম। সেখানে ওদের পাড়ার এক কাকু কাকীমার সাথে দেখা হলো। তখন সুমনার কথা জিজ্ঞেস করাতে ওনারা এইটুকুই বললেন। মানে এইটুকুই শোনা হলো। ওনারা ব্যস্ত ছিলেন। বেশী কথা হয়নি।
এই সুমনা ছিল আমাদের ব্যাচের সবথেকে সুন্দরী। কলেজের প্রায় সব ছেলেরা ওর জন্য পাগল ছিল। কিন্তু ও কাউকে পাত্তা দিত না। আকাশ বলে আমাদের এক সিনিয়র দাদা ছিল। কলেজের ইউনিয়ন লিডার ছিল। দেখতে দারুণ। যেমন হ্যান্ডসাম, তেমন স্মার্ট। দারুন গানের গলা। আকাশদা মনে মনে ভালবাসতো সুমনা কে।
__ মনে আছে বন্দনা, আকাশদাকে?
__ হ্যাঁ মনে আছে। সেই ইউনিয়ন লিডার।
__ হ্যাঁ, তোর নিশ্চয় এটাও মনে আছে যে আকাশদা সুমনাকে ভালবাসতো।
__ হ্যাঁ, কিন্তু সুমনা পাত্তা দিত না।
__ জানিস বন্দনা আজ আকাশদাকেও দেখলাম এসেছে।
__ কি সুন্দর গানের গলা আকাশদার।
এদিকে মাইকে অ্যানাউন্স হচ্ছে, এবার তোমাদের সামনে সঙ্গীত পরিবেশন করবে আমাদেরই কলেজের প্রাক্তন ছাত্র আকাশ সেন।
__ মানালি চল আকাশদা গাইবে শুনে আসি, বলে উঠল বন্দনা।
__ হ্যাঁ চল চল।
আমরা চলে গেলাম স্টেজের কাছে। আর যা দেখলাম নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। দেখলাম সেই আকাশদা আর এই আকাশদার মধ্যে আকাশ পাতাল ফারাক। আমাদের আগের আকাশদা ছিল ভীষণ হ্যান্ডসাম। সবসময় পাঞ্জাবি পরে আসত কলেজে। আর ঝকঝক করতো মুখ চোখ। হাসিখুশি থাকতো। আর আজ যেই আকাশদাকে দেখছি দাড়ি ভর্তি বিবর্ন মুখ, বিষাদ মাখা হাসি, অবসন্নতাময় চোখ। আকাশদা গান গাইতে আরম্ভ করলো। গানের গলায় আজও সেই মধু ঝরে পড়ছে। কিছুক্ষণের জন্য আমরা সবাই আকাশদার গান শুনলাম মনোমুগ্দ্ধের মতো। হাততালির আওয়াজে মুগ্ধ ভাব কাটলো। দৌড়ে গেলাম স্টেজের পেছনে। গিয়ে দেখি আকাশদা বেরিয়ে গিয়েছে।
__ যাঃ বন্দনা আকাশদার সাথে দেখা হলোনা।
একরাশ মন খারাপ নিয়ে আমরা ফিরে আসতে লাগলাম।
__ শোননা মানালি একদিন সুমনার সাথে দেখা করতে যাবি?
__ চল, তোর যদি সময় হয় তাহলে কালকেই চল।
__ হ্যাঁ আমার সময় হবে। তাহলে কাল বিকেলে যাব।
কথামত পরের দিন বন্দনা আর আমি সুমনাদের বাড়ি গেলাম। ওই দরজা খুললো। আমাদের দেখে অবাক হয়ে গেল।
__ কিরে আমি মানালি। চিনতে পারছিস?
__হ্যাঁ হ্যাঁ, কেন চিনতে পারবনা। মানালি আর বন্দনা। বস, তোরা হঠাৎ?!!
__ আরে এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, ভাবলাম অনেকদিন তোর সাথে দেখা হয়না, তাই ….
__ ওঃ কি খাবি বল? চা না কফি?
__ চা খাব কিন্তু পরে। একটু গল্প করে নিই।
__ হুম। কেমন আছিস বন্দনা?
__ ভালরে।তুই?
__ আছি। চলে যাচ্ছে। আর মানালি তুই কেমন আছিস?
__ ভাল আছিরে।সুমনা তোর চোখ মুখ এত শুকনো কেন? শরীর খারাপ?
__ না না।
__ ওঃ।
বলতে বলতে একটা ফটোফ্রেমে চোখ আটকে গেল। দেখলাম আকাশদার সাথে সুমনার ছবি।
__ কিরে সুমনা তোর কি আকাশদার সাথে বিয়ে হয়েছে?
__ হ্যাঁ হয়েছিল।
__হয়েছিল মানে?
আমি কৌতুহলী হয়ে প্রশ্ন করলাম।
__হয়েছিল মানে এখন আমাদের ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে।
আমি বন্দনার দিকে তাকালাম বন্দনা আমার দিকে তাকালো। কি বলবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। চারিদিকে যেন একটা গুমোট বাতাবরণ তৈরী হয়ে গেল মূহুর্তে। সুমনাই বলে উঠল, বস তোরা। আমি চা করতে বলছি। সুমনাকে দেখে মনে হল যেন ওর উঠতে বসতে খুব কষ্ট হচ্ছে। চোখের নিচে কালি, ঠোঁট দুটো ফ্যাকাশে। চা আসল। আমি চা খেতে খেতে জিজ্ঞাসাই করে ফেললাম__কিছু যদি মনে না করিস সুমনা, তাহলে জানতে পারি কি হয়েছিল যার জন্য তোদের সংসার ভেঙে গেল?আকাশদার কি কোন সমস্যা ছিল?
__না না ওর কোন সমস্যা ছিল না।
__ তাহলে? কি হয়েছিল?
সুমনার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল গড়িয়ে পড়ল।
__ আসলে সমস্যাটা আমার। আমার ব্রেন ক্যান্সার ধরা পড়েছে। আমি বেশিদিন বাঁচবনা।
আমি আর বন্দনা হতবাক হয়ে গেলাম। মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। সুমনা বিড়বিড় করে বলে চলল___ আকাশ আমায় ভীষন ভালবাসে। আমিও খুব ভালবাসি। আমরা কখনো কোনদিন বিয়ের পর কেউ কাউকে কষ্ট দিইনি। খুব সুন্দর ভাবে আমাদের সংসার গুছিয়ে নিচ্ছিলাম। একটা বেবীর প্ল্যানও করছিলাম। কিন্তু তার মধ্যেই আমার এই অসুখ ধরা পড়ল। আমি ওকে জানাইনি পর্যন্ত। আমি চাইনি ওর চোখের সামনে আমি তিলে তিলে কষ্ট পেয়ে শেষ হয়ে যাই। আর ও সেটা দেখে কষ্ট পাক দিনের পর দিন।
__ সেতো বুঝলাম, কিন্তু তোদের ডিভোর্স হলো কেন?
__ আমি চাইনি ও আমার শেষের কষ্টের জীবন, বিভৎস চেহারা মনে রাখুক আর কষ্ট পাক। এর থেকে আগে থেকে আলাদা থাকার কষ্টটা অনেক ভাল। আমার প্রতি ওর রাগ হবে, কষ্টটা তুলনায় কম হবে।
__ এটা কোন কথা হল! আকাশদা তো এখনও কষ্ট পাচ্ছে।
__ হুম জানি, কিন্তু তবু ভাল ওর সেই কষ্ট আমি সামনে থেকে দেখছি না। আর ওকেও আমার তিলে তিলে শেষ হয়ে যাওয়া দেখতে হচ্ছেনা। ওকে বলেছি আবার বিয়ে করে সংসার করতে।
আমি আর বন্দনা রাস্তায় ফিরতে ফিরতে একটা কথাও বলতে পারিনি। আমি শুধু ভেবে গিয়েছি এ কেমন ভালোবাসা! কি অপরিসীম ভালোবাসা! যার জন্য দুঃখ কষ্ট একাই বহন করতে রাজি। ভালোবাসার মানুষকে শুধুই ভালোবাসতে চায়। কোন ব্যথাতুর স্মৃতি যেন ভালোবাসার মানুষের মনের কোঠায় না থাকে, সেই চেষ্টায় প্রতিনিয়ত নিজেকে নিয়োজিত রাখা। জানিনা সুমনা যা করছে ঠিক না বেঠিক। তবে যা করেছে আকাশকে ভীষন ভালোবাসে বলেই করেছে।
**************************************
__